স্টাফ রিপোর্টার//সময়নিউজবিডি
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশ সফরে আসার প্রতিবাদে সড়ক অবরোধ অগ্নিসংযোগ ও ভাংচুরের ঘটনায় গতকাল ২৬ মার্চ থেকে উত্তাল পুরো ব্রাহ্মণবাড়িয়া। এসব ঘটনার জেরধরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে মোদি বিরোধী বিক্ষোভকারীদের সংঘর্ষে ৫ জন নিহত হয়েছে। এতে আহত হয়েছে আরো ১৬ জন। এদিকে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের সাথে মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। এতে উত্তপ্ত হয়ে উঠছে জেলা শহরের পরিস্থিতি।
শনিবার (২৭ মার্চ) সন্ধ্যা ৬ টায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলার নন্দনপুর এলাকায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে বিক্ষুব্ধদের সংঘর্ষে এ হতাহতের ঘটনাটি ঘটেছে।
অপরদিকে, শুক্রবার ও শনিবার জেলা শহর জুড়ে মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের তাণ্ডবের ঘটনার প্রতিবাদে বিকেলে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা ছাত্রলীগের একটি প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ মিছিল বের হয়। মিছিলটি জেলা শহরের কান্দিপাড়া মাদ্রাসা মোড় এলাকায় আসলে জামিয়া ইসলামিয়া ইউনুছিয়া মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের সাথে ছাত্রলীগের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া শুরু হয়। পরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন।
নিহতরা হলেন – সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার দাবির মিয়ার ছেলে বাদল মিয়া (২৪), ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলার বুধল ইউনিয়নের নন্দনপুর গ্রামের আব্দুল লতিফ মিয়ার ছেলে জুরু মিয়া (৩৫), একই উপজেলার মজলিশপুর ইউনিয়নের মৈন্দ গ্রামের জুর আলীর ছেলে সুজন মিয়া (২২) একই উপজেলার কাউসার মিয়া (২৪) ও জোবায়ের (১৪)। আহতদের মধ্যে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় নুরুল আমিন, বাছির মিয়া ও সাদেক মিয়া নামে তিনজনকে জেলা সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। বাকীদের স্থানীয়ভাবে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, শনিবার বিকেলে কুমিল্লা- সিলেট মহাসড়কের ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলার বুধল ইউনিয়নের নন্দনপুর এলাকায় পুলিশ বিজিবির সাথে মোদি বিরোধী বিক্ষোভকারীদের সংঘর্ষ বাঁধে। এতে কয়েকজন বিক্ষোভকারী গুলিবিদ্ধ হলে তাদেরকে উদ্ধার করে জেলা সদর হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসকরা তিনজনকে মৃত ঘোষণা করেন এবং বাকী কাউসার ও জোবায়ের নামে দুজন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সন্ধ্যায় মারা যান।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালের চিকিৎসক আব্দুল্লাহ আল মামুন এ প্রতিবেদককে জানান, শনিবার সন্ধ্যায় গুলিবিদ্ধ অবস্থায় তিনজনকে হাসপাতালে আনা হয়। তবে হাসপাতালে নিয়ে আসার আগেই তাদের মৃত্যু হয়।
অন্যদিকে, শনিবার বিকেলে জেলার সরাইল উপজেলার অরুয়াইল এলাকায় স্থানীয় বাসিন্দা ও মাদ্রাসা শিক্ষার্থীরা মোদি বিরোধী বিক্ষোভ মিছিল বের করেন। পরে মিছিলে অংশগ্রহণকারীরা অরুয়াইল পুলিশ ক্যাম্পে হামলা ও ভাংচুর চালায়। এতে পুলিশ ক্যাম্পের অন্তত ২৫ পুলিশ সদস্য আহত হয়। পরে পুলিশ রাবার বুলেট ও টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন।
এ ব্যাপারে সরাইল থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি তদন্ত) মোঃ কবির হোসেন জানান, বিক্ষোভ মিছিল থেকে হঠাৎ বিক্ষুব্ধরা পুলিশের ওপর ইটপাটকেল ছুঁড়ে। বর্তমানে পরিস্থিতি পুলিশের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।
এদিকে মহান স্বাধীনতা দিবস ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী অনুষ্ঠানে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশ সফরে আসার প্রতিবাদে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের তাণ্ডবে দুদিন ধরে অচল হয়ে পড়েছে পুরো ব্রাহ্মণবাড়িয়া। এতে জনজীবনে দুর্ভোগ ও ভোগান্তির সৃষ্টি হয়েছে।
গতকাল শুক্রবার ২৬ মার্চ বিকেল ৩ টা থেকে কুমিল্লা-সিলেট মহাসড়কের ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌর এলাকার ভাদুঘর, পৈরতলা, পীরবাড়ি পুলিশ লাইন, ঘাটুরা, ঢাকা-চট্রগ্রাম ও ঢাকা-সিলেট রেলপথের ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা শহরের পুনিয়াউট রেলগেইট, সরকারি কলেজ সংলগ্ন রেলগেইট, ভাদুঘর রেলগেইট ও জেলা শহরের কালীবাড়ি মোড়, কান্দিপাড়া মাদ্রাসা মোড়, মঠেরগোড়া, পৌর মুক্তমঞ্চ, পৌর আধুনিক সুপার মার্কেট, ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল স্কুল চত্বর, কুমারশীল মোড় ও টেংকেরপাড় এলাকায় সড়ক ও রেলপথ অবরোধ করে বিক্ষোভ মিছিল ও অগ্নিসংযোগ করেন মাদ্রাসা শিক্ষার্থীরা। এসময় বিক্ষুব্ধরা ব্রাহ্মণবাড়িয়া রেলওয়ে স্টেশনের সিঙনাল প্যাণেল, টিকেট কাউন্টার, যাত্রীদের বিশ্রামাগার কক্ষসহ কয়েকটি কক্ষে অগ্নিসংযোগ ও ভাংচুর চালিয়ে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি করেন। এতে করে ঢাকা-চট্রগ্রাম ও ঢাকা-সিলেট রেলপথের কয়েকটি ট্রেন আটকা পড়ে চরম দূর্ভোগ ও ভোগান্তির শিকার হয় যাত্রীরা। তবে রাত ১২ টা নাগাদ তালশহর ও পাঘাচং রেলওয়ে স্টেশনের সিঙনাল ব্যবহার করে আটকাপড়া ট্রেনগুলো ব্রাহ্মণবাড়িয়া স্টেশন অতিক্রম করেন।
অপরদিকে, মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের হামলা ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগের শিকার হয়েছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অধিকাংশ সরকারি স্থাপনা ও গাড়ি। হামলাকারীরা সিভিল সার্জন কার্যালয়, জেলা মৎস্য অফিস, পুলিশ সুপার কার্যালয়, গণপূর্ত বিভাগের কার্যালয়, জেলা প্রশাসকের সার্কিট হাউস, জেলা পরিষদ ডাকবাংলো, জেলা ও দায়রা জজের বাসভবন, জেলা প্রশাসকের বাসভবন, পুলিশ সুপারের বাসভবন, অবকাশ, জেলা পরিষদ কার্যালয়, টিএনটি অফিস, পৌর ভবনে ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ করেন। এতে আশিক মিয়া (২০) নামে এক ওয়ার্কশপ মিস্তিরি নিহত হয়েছেন এবং পুলিশ সাংবাদিক ও পথচারীসহ ১০ জন আহত হয়। পরে বিকেলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে রেলওয়ে স্টেশনে পুলিশ টিয়ারসেল নিক্ষেপ করে বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করেন। সন্ধ্যায় জেলা শহরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সড়ক ও সরকারি স্থাপনার সামনে বিজিবি মোতায়েন করা হয়।
এদিকে আজ শনিবার সকাল থেকে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত রেলপথ যোগাযোগ স্বাভাবিক রয়েছে বলে গণমাধ্যমকে নিশ্চিত করেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া রেলওয়ে স্টেশনের স্টেশন মাস্টার সোয়েব আহমেদ।
তবে ব্রাহ্মণবাড়িয়া রেলস্টেশনে আজ শনিবার থেকে কোন ধরণের ট্রেন থামবে না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে রেল কর্তৃপক্ষ। রেলস্টেশনে হামলা-অগ্নিসংযোগ করে স্টেশনের সিগন্যালিং সিস্টেমসহ সকল ব্যবস্থাপনা অচল করে দেয়ায় কর্তৃপক্ষ এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া রেলস্টেশন মাস্টার শোয়ের আহমেদ বিষয়টি নিশ্চিত করে জানান, পূর্বাঞ্চল রেলওয়ের কন্ট্রোল রুম থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া রেলস্টেশনে সব ধরণের ট্রেন না থামার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। যারা আন্ত:নগরসহ বিভিন্ন ট্রেনের আগাম টিকিট সংগ্রহ করেছেন, তাদের টাকা ফেরত দেয়ারও সিদ্ধান্ত হয়েছে। পরবর্তী নির্দেশনা না দেয়া পর্যন্ত এ সিদ্ধান্ত বলবৎ থাকবে বলেও জানানো হয়।
ইনাম/সময়নিউজবিডি টুয়েন্টিফোর।
Leave a Reply